ছবি : সংগৃহীত
কয়েক বছর আগে মেলবোর্নে গিয়েছিলাম আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ দেখতে। যতই বন্ধুত্বপূর্ণ হোক না কেন এ দুই দেশের খেলা মানেই গরম হাওয়া। উড়ে দিয়ে যখন মেলবোর্ন পৌঁছেছিলাম তখন বিকেল। মাঠের কাছাকাছি যত যাই, হাজার হাজার ভক্তের ভিড়। সেই পরিচিত দৃশ্য। একদিকে নীল সাদা আরেকদিকে হলুদের ভিড়। বাঁশি, বিউগল, ড্রাম, চিৎকার-চেঁচামেচি, বিয়ারের ক্যান, গরম আলুভাজি– কিছুই বাদ ছিল না। কিন্তু দর্শক গ্যালারি কি করেছিল ওইদিন? এক এক করে খেলোয়াড়দের নাম ঘোষণার সময় তারা করতালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ে সমর্থন জানাচ্ছিল। তবে যে মুহূর্তে মেসির নাম ঘোষণা করা হলো মাঠের প্রায় সব দর্শক তাদের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানাতে ভুল করল না। এক নিমিষে দুটি দলের চাইতে বড় হয়ে উঠেছিল ফুটবল খেলা। বড় হয়ে উঠেছিল সম্মানের জায়গাটি। সেদিন মাঠে থাকা বা টিভির পর্দায় খেলা দেখা তরুণ-তরুণী আর ছোটরা জেনে গিয়েছিল এটাই নিয়ম। এটাই সৌজন্য।
আমরা এখনো সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের সমর্থনের জায়গাটা দেশের রাজনীতির আদলে তৈরি। যেন আওয়ামী লীগ মানেই বিএনপি বিরোধিতা আর বিএনপি মানেই আওয়ামী শত্রুতা। মনস্তাত্বিকভাবে কথাটা আমাদের জাতির জন্য সত্য। আমরা আমাদের দেশ, পতাকা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও দ্বিধাবিভক্ত। আর এ তো দুটি বিদেশি দেশ ও দলের খেলা। এমন সমর্থন বা জোয়ারের ভালো দিক হচ্ছে ওই সময়টুকুতে অন্য সব মন্দকাজ বা খারাপ কিছু থেমে যাবে, থমকে দাঁড়াবে।
আর খারাপ দিক? অনেক সময় এমন বৈরী আর কলহের পরিবেশ তৈরি হয় যা বছরের পর বছর এমনকি জীবনভর চালু থাকে। বন্ধ হয়ে যায় আনাগোণা, রুদ্ধ হয়ে পড়ে বন্ধুত্বের দরজা। পাড়া-মহল্লায় যাদের শ্রেষ্ঠত্ব আর জয় কামনায় এই সব করা হয় তারা কিন্তু আমাদের চেনে না। চিনলেও ভালো করে জানে না। না জানার কারণ, ফুটবলে আমরা অনেক পিছিয়ে। র্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান এত নিচে যে আগামী তিন দশকে তা টপকানো হবে স্বপ্নের ব্যাপার। বরং সেদিকে মনোযোগ দেওয়াই কাজের কাজ।
এই যে পুরো দেশ বিশ্বকাপ নিয়ে পুলকিত এবং জেগে ওঠার জন্য মুখিয়ে, আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, আমাদের সন্তানদের খেলার জন্য ভালো কোনো মাঠ নেই। শহরের বাসিন্দারা তাদের সন্তানদের কোথায় খেলতে পাঠাবেন? কোথাও নেই অক্সিজেন নেওয়ার মতো ফাঁকা মাঠ বা জায়গা। এরকম সমাজে এ ধরনের উন্মাদনা কতটা যৌক্তিক? তাছাড়া খেলাকে খেলার জায়গায় কি রাখতে পারি আমরা? এই বিশ্বকাপ নিয়ে কত যে অঘটন ঘটবে তা এখনই বলে দেওয়া যায়। সবচেয়ে সাংঘাতিক বিষয় প্রাণ হারানো। মারামারি বা লড়াইয়ে জান যাবে মানুষের। খেলার জয়-পরাজয় মানতে পারা না পারাও এর কারণ হবে। অথচ জানবে না কেন হারল বা কীভাবে জিতে বেরিয়ে গেল।
এত বেশি জনসংখ্যার চাপে কাউন্সিলিং কিংবা সবাইকে বোঝানো অসম্ভব। পথ একটাই। মিডিয়া যেন সংযত থাকে। সকলকে যেন নিয়ন্ত্রিত আবেগের বিষয়টা বুঝিয়ে দেওয়া যায়। পতাকা বানানো ঠিক আছে কিন্তু গাঁটের টাকা খরচ করে যারা ভিন দেশের পতাকা উড়িয়ে গর্ব করেন তাদের কজনের বাড়িতে স্বদেশের পতাকা আছে? কজন জাতীয় দিবসে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান?
খেলার নিয়ম অনুযায়ী একদল জিতবে, একদল হারবে। হারলেও মেসি, রোনালদো বা নেইমার সুপারস্টার। তাদের ক্যারিয়ার এবং তাদের জায়গা নিশ্চিত। এখনই যারা অশ্লীল ভাষায় তাদের আক্রমণ শুরু করে দিয়েছেন ট্রফি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ট্রল করছেন তাদের সংযত হবার বিকল্প নেই। ফুটবলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ফিফা সভাপতির কাছে এখন খেলার চেয়েও বড় রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধ সামলানো। ওই কারণে তিনি খেলার দিনগুলোতে যুদ্ধ বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন। আশা করি তেমনটিই হবে এবং ওই বিরতির পর আর যুদ্ধমুখী হবে না তারা। মাঠের লড়াইকে মাঠেই রেখে নিজেদের সমর্থন বা অসমর্থন বজায় রাখার নাম আধুনিকতা। বিশ্বকাপ যেন বিশ্বচাপে পরিণত হয়ে না পড়ে, সকলকেই লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকে।