ছবিতে বাবার সাথে লেখিকা শাহীন আক্তার স্বাতী
গেল বার যখন দেশে গেলাম, বাবা সবুজ রঙের একটি ফাইল আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন খুলে দেখতে। ফাইলটা খুলে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে মাকে নিয়ে আমার লেখা প্রথম কবিতা, যেটা কিনা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সেই পত্রিকা! একে একে আমার স্কুল জীবনের বহু বছরের পুরোনো ছাপা অক্ষরের কবিতাগুলো বের হয়ে আসতে লাগল। আমি ভেবেছিলাম পত্রিকাগুলো বোধ হয় হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা যে উপহার দিয়েছিলেন, তা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। বাবা বলেছিলেন, কিছু স্মৃতি যত্ন করে রাখতে হয় তা না হলে পরে আফসোস করতে হয়। আসলেই আমি আফসোস করতাম। বাবা সব সময়ই চাইতেন আমি যেন লিখি। দাদার মতো হই। দাদা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচিত্র ‘মুখ ও মুখোশের’ গীতিকার। দাদার লেখা কত গান, কত কবিতা, কত অনবদ্য সৃষ্টি। আমি বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। কেন জানি লেখালিখি কমিয়ে দিয়েছিলাম। বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছিলাম। এখন সময় পেলেই কবিতা লিখি। দাদার মতো বিখ্যাত হওয়ার জন্য নয়, শুধু বাবার মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য। বাবার জন্য যে কিছুই করতে পারিনি। এই অনুশোচনা প্রতিনিয়ত আমায় দগ্ধ করে।
বাবার যে হাত ধরে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম সে হাত আমার অফিস যাওয়া পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়? আমি উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে বাবা অবসর গ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন বিনিয়োগ বোর্ডের কর্মকর্তা। সবাই বাবাকে বুদ্ধি দিয়েছিল মেয়ে বিয়ে দিতে কিন্তু বাবা তা করেননি। বাবা সব সময় চাইতেন মেয়ের পড়াশোনা শেষ করে স্বাবলম্বী করে তবেই বিয়ে দেবেন এবং তিনি তা করেছেনও। আমার পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ভিনদেশে ঘর বাঁধার জন্য আমার ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষকের চাকরিটা ছাড়তে হয়েছিল। এতে বাবা মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি যে বাবার স্বর্গরাজ্যের রাজকন্যা হয়েই অনেক সুখী ছিলাম এ কথা কী করে বোঝাই। ভিনগ্রহের এক একাকী এলিয়েন আজ ডুকরে ডুকরে কেঁদে মরে বাবার স্বপ্ন ভঙ্গের অনুশোচনা নিয়ে। তবে ভাঙা স্বপ্নগুলোকে বাক্সবন্দী করে রেখেছি একটা মেঘমুক্ত আকাশের প্রতীক্ষায়। যেদিন আমার আকাশের সব কালো মেঘ সরে যাবে, সেদিন বাবার স্বপ্নগুলোও পূর্ণ হবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস!
বাবাকে নিয়ে লেখা যেন শেষ হতে চায় না। বাবা একদিকে যেমন ছিলেন শিক্ষাগুরু অন্যদিকে ভালো বন্ধু। আমি একজন সৎ কর্মকর্তাকে দেখেছি যিনি কখনো টাকার পেছনে ছোটেননি, ছুটেছেন সন্তানদের পেছনে। কখনো বলতে পারব না বাবা আমাদের সময় দেননি। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তেও বাবা এখনো পাশে থাকেন বন্ধুর মতো।
এখন এই বৃদ্ধ বয়সে বাবা আমার ছোট্ট ছানা দুটোকে দেখে হাসেন, খেলা করেন আর তা দেখে আমিও হাসি। বাবার এই হাসি আমি আজীবন দেখতে চাই। বাবা যে আমার জগতে সবচেয়ে সেরা বাবা।
মহান আল্লাহর কাছে এইটুকুই প্রার্থনা, তিনি যেন আমার বাবাকে সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন ও দীর্ঘজীবী করেন।
ওই গানটা ভীষণ মনে পড়ছে…
‘মন্দ হোক ভালো হোক, বাবা আমার বাবা
পৃথিবীতে বাবার মতো, আর আছে কে বা…?’
আর এ