সোমবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ২৫ ১৪৩১

শুভ্রতার কবি এগিয়েছে বিপ্লবী গানে

গোলাম রববানী

প্রকাশিত: ২১:০৮, ১১ জুন ২০২২

আপডেট: ২১:২৬, ১১ জুন ২০২২

শুভ্রতার কবি এগিয়েছে বিপ্লবী গানে

কাব্যগ্রন্থ শপথ ভাঙার ইশতেহার

কবির প্রতিটি কবিতার নাম দিয়েছি আনন্দসন্তান।যা কাব্যসম্ভারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলিষ্ঠ হুঙ্কারে, সাহসীকতার হিম্মতে,পদক্ষেপে, বিপ্লবে আর বিদ্রোহের কর্মকাণ্ডে যা দ্বারা উপকৃত হবে সৃষ্টির সেরা জীব।যাতে কাব্যপাঠক, পাঠক-পাঠিকা অনন্তকাল যেন বেঁচে থাকে আনন্দ নিয়ে।কবিতার স্বাদ নিয়ে। মানুষের ভালোবাসা আর সহমর্মিতা নিয়ে।আনন্দের নির্যাসমিশ্রিত কাব্যরস নিয়ে।শপথ গড়ার কারিগরের বিশ্বাসের আলোয় বেঁচে থাকে কাব্যপ্রাণ, মনুষ্যপ্রাণ-কাব্যকবিতা ফিরে পায় অমরত্বের স্বাদ!আর সেই স্বাদ হোক 'শপথ ভাঙার ইশতেহার' কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগের শিল্পমণ্ডিত কাব্যময় এই বইটি। সর্বসাধারণের পাঠ বোধগম্যের জন্য এই বইটি হবে অনন্যসাধারণ।তেমনি মানবমুক্তিরও বটে!শব্দের নতুনত্বের আদরে, সহজ সরল ভাষার সাগরে অবলীলার অবগাহনে  এক নিমিষেই ভেজাতে পারবে কাব্যপ্রেমীর সমস্ত কাব্যেরশরীর।সেটা হোক আনন্দের শরীর;এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে এমনকি আস্বাদনের মাধ্যমে। নষ্টরাজনীতির বৈপরীত্যে শান্তিপূর্ণ পলিটিক্সের আহবান জানিয়েছেন কবি তারঁ শপথ ভাঙার ইশতেহারের প্রতিটি কবিতায়।কবিতা বইটি হাতে নিয়ে পাঠ করলেই বোধগম্য হবে সমাজ সংসার কিভাবে গোল্লায় যাচ্ছে ক্ষমতাখেকো নরশয়তানদের দ্বারা।কবি অতি সত্বর সেই নষ্টামিতমহাসড়ক সংস্কারের উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন তাঁর শপথ ভাঙার ইশতেহার বইটিতে।যেন মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে চলার পথটি পাড়ি দিয়ে অনন্তের দিকে যেতে পারে নির্ভয়ে, প্রত্যয়ে আর বিশ্বাসে।

অনিয়ম,অত্যাচার, অবিচার,অন্যায়, ব্যভিচার এর বিরুদ্ধে, শোষিত মানুষেরজীবন-যন্ত্রণা,বিক্ষোভ-বিদ্রোহের বলিষ্ঠ হুঙ্কার,দুর্নীতিরাজ্য আর আমিত্বরাজ্য ভাঙার এটিই মূল হাতিয়ার। শপথ ভাঙার ইশতেহার এমন-ই একটি বই।কবি প্রতিটি কবিতায় জন্ম দিয়েছে এক একটি করে সার্থকপুত্র।আনন্দপুত্র।বিশ্বাসপুত্র!যেন নিশ্চিতে চোখবুঁজে ভরসা, শ্রদ্ধা,ভক্তি এবং ভালোবেসে দূর থেকে বহুদূরে নির্ভরতার রথে চড়ে অকল্যাণ-অনিয়মের শেকড় ভেঙে অনায়াসে আগামীর দিনগুলি পেরোনো যায়।যাকে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে শিকড় ভাঙার ইশতেহার। মানবকল্যাণার্থে, মানবমুক্তি এবং রাজনৈতিক দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রতীক হিসেবে এই কাব্যগ্রন্থটি অনন্যসাধারণ এবং স্বতন্ত্রতার পরিচয় বহন করে।মৌলিকত্বের এক অতিনবতারায় জ্বাজ্জল্যমান বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা। কাব্যকলার এই সুদৃষ্টি আকর্ষণে মানবমুক্তি এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? বোধ হয় কবির স্বার্থকতা এখানেই- বৈকি!
তবে জন্ম দিয়েছেন ঘৃণ্যপুত্রও! চামচামিপুত্র!পা চাটা ক্যাডারপুত্র! কবি সাবলীল শব্দের মারপ্যাঁচে কঠিনতম শব্দকে পদদলিত করেছেন দমবন্ধ হওয়া সংসারকে মুক্ত করার জন্য-"যার নাম দিয়েছে শপথ ভাঙার ইশতেহার - এটি আসলেই ভালোবাসার বিশ্বাসের অমূল্য দলিল;খাঁটি এক ইশতেহার।কুচক্রী পাক হানাদার বাহিনীর মতো স্বদেশী দেশীয়দোসররা পাশবিকতার প্রতীক- তাদের মুখোশ উন্মোচিত করার দলিল হিসেবে বিবেচ্য  কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগ এই কবিতাটি বইটি।"

ইশতেহার শব্দটি আরবি ভাষা থেকে আগত।কোনো কিছুর বিজ্ঞাপন দেওয়া কিংবা প্রচার প্রচারণা করা কিংবা হতে পারে কোনো কিছুর পূর্বনোটিশ দিয়েই ঘোষণা করা; যে এই কাজটি আমি ভবিষ্যতে করে দেবো- এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করা কিংবা উচ্চারণ করা।কিন্তু আজকাল লক্ষণীয় মাঠে-ময়দানে, চায়ের কাপে ঝোড়ো সংলাপে, টকশোতে, অফিসে আদালতে, মজলিস সমাবেশে, পাড়া মহল্লার কিংবা শহর বন্দরের মোড়ে মোড়ে,অলিতে-গলিতে,  সংসদ পার্লামেন্টে, শিক্ষাঙ্গনে,সংবিধানের নিয়মকানুনে, মসজিদ- মন্দির - গির্জা-প্যাগাডোতে আমরা কতোই-না কতো কিছু ইশতেহার ঘোষণা করছি।প্রাইভেট ইশতেহার,কর্পোরেইশতেহার,বিজনেস ইশতেহার, কাঠামো অবকাঠামোগত ইশতেহার, সরকারি-বেসরকারি অথবা আধা-সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত অথবা পরিবার-রাষ্ট্র-সমাজ-সংসার-বিশ্বপরিমণ্ডলে,সংঘে,জাতিসংঘে কতোই-না ইশতেহার ঘোষণা করে ফেলছি।অবজ্ঞার সহিত সেটা আবার কী সহজে অমান্য করে ফেলছি-যেন বড্ড ভুলোমন; বেমালুম সেটা আবার ভুলে যায়।কথা দেওয়ার চেয়ে কথা না দেওয়ায় হয়তো শ্রেয়! হয়তো স্বার্থসিদ্ধি লাভের জন্যই এমনটা করে থাকে বিশ্বপ্রকৃতির চোখ।ধুর!  বেকুব! হয়তো স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেন? বরং স্বার্থ হাসিলের জন্য-ই তো। মানে মুখে একরকম আর কাজে আরেকরকম প্রমিনেড করি।গড়িমসি করি।কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগ ঠিক এমন কিছু একটা ভেবে কাব্যগ্রন্থটির চমৎকার নামকরণ করেছেন।সাধু! সাধু! সাধু!
আমার কাছে যথার্থ এবং সার্থক নামকরণ হয়েছে বলে মনে হয়।কবির কবিতাগুলো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মানুষের জীবনের ধামাচাপা কথাগুলোকে কিভাবে কবিতায় আগ্নেয়াস্ত্রের মতো ব্যবহার করেছেন। কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগের কবিতাগুলো সময়ের দুঃসময়ের কথা বলে। কবির 'শপথ ভাঙার ইশতেহার' কাব্যগ্রন্থটি ৬০ টি কবিতা দিয়ে ঢেলে সাজানো। যেন এক একটি কবিতা এক একটি অস্ত্রের মতো। আগুনের ফুলকির মতো। কবিতার শব্দ,উপমা,রূপকতা,অলঙ্কারাদি, ভাষাগুলো যেন দাউদাউ করে জ্বলছে অনিয়ম শৃঙ্খলহীনতাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য।বিদ্রোহের হুঙ্কার ছাড়ছে।

কাব্যগ্রন্থটিতে রূপ-রস-ছন্দ-অলঙ্কারের ঊর্ধ্বে নতুনতর মৌলিকত্বের শব্দসম্ভারে ছুঁয়েছে বলে আমার মনে হয়।বিশেষত লক্ষণীয় কবি তাঁর কবিতাগুলোতে কাব্যসূর্যের ভেতরযন্ত্রণাকে পেছনে ফেলে রূপক খোলসের প্রচ্ছদ এঁকেছেন সূর্যের মতো তেজোদ্দীপ্ত করে।তাইতো কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং আগামীর গণতন্ত্রকামী কলম সৈনিকদেরই তাঁর কবিতাগ্রন্থটি উৎসর্গঃ করেছেন।

 'শপথ ভাঙার ইশতেহার' কাব্যগ্রন্থটির
লেখক কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগ। কবি মো.খালেদ উদ-দীন সম্পাদিত বুনন প্রকাশনী থেকে নভেম্বর, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ৫০৪, কাকলী শপিং সেন্টার, জিন্দাবাজার, সিলেট -৩১০০
বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন আইয়ুব আল আমিন।

অবিনশ্বর ভাবনার স্মারকঃ
.
অবিশ্রান্ত লিখে যাও
বিপন্ন মুক্তির এই করিডোরে
প্রতিবাদী প্লাবনে উছলে উঠুক যৌবন।
.
তবু শৃঙ্খল ফিরে আসুক
ফিরে আসুক আগমনী গান
জবান খুলে যাক...
(কবিতাংশ)
রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলতে হয় -সহজ কথা যায় না বলা সহজে কিন্তু কী সাংঘাতিক ব্যাপার ! কবি তাঁর অবিনশ্বর ভাবনার স্মারকে কী সুন্দর সহজ সরলভাবেই না উপস্থাপন করেছেন তাঁর মনোভাব। সমাজের তথা দেশে অনিয়মের কথা।আহবান জানিয়েছেন সংকটাপন্ন এই দুঃসময়ে জেগে ওঠো,প্রতিবাদী হও, বিপ্লবী হও, অস্তিত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ো না, অঙ্গীকারবদ্ধ হও! সুশৃঙ্খল কথাবার্তা আর রুচিসম্মত  বিবেকবোধে চিন্তাভাবনাকে তিঁনি জিইয়ে দিয়েছেন।সাংবিধানিকভাবেই  বিধিবিধান নিয়মকানুন লঙ্ঘিত হচ্ছে।বাকস্বাধীনতা থ বনে যাচ্ছে সেটাকেই কবি উজ্জীবিত করার আহবান জানিয়েছেন।
বাহ! কী সুন্দরভাবেই না কবি মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন.. জবান খুলতে বলেছেন।মূলত মানুষকে কবি সাহসী হতে বলেছেন। অপ্রাণীবাচক প্রাণীদের ঊর্ধ্বে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

সভ্যতার আড়ালে পৈশাচিক চোখঃ

অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির রোষানলে
অস্পৃশ্য মেঘ পুঁজিপতি শক্তির বাহুবন্ধনে
বাটোয়ারা হয় মধ্যবিত্তের মুখের খোরাক...

নষ্ট ভাগ্যই বটে আমাদের

আয়ুরেখা শেষ হবে জানি
তবু কেন কানাকানি - মগজের প্যাঁচ
কেন এত বিশ্বাসের ভাঙন খেলা
আঁতলামি মানুষের স্বর...

অতঃপর শিকারী পাখিরা এখনো প্রস্তুতি নিচ্ছে...
(কবিতাংশ)

কবিতাটির কী চমৎকার নামকরণ-ই না করেছেন কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগ! কবিতা নামকরণ-ই বলে দেয় একটি কবিতার স্বভাব চরিত্র। কথায় বলে যে মুলোটা বাড়ে তার পাতা দেখলেই বোঝা যায়।আমরা জানি মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব।কিন্তু এই শ্রেষ্ঠ জীবকে নিয়ে যদি রাজনৈতিক আগ্রাসন খেলা হয়; মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় স্বয়ং আল্লাহ-ই সেই সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্রের শোষকশ্রেণীর প্রতি নারাজ হন। গজব নাজিল করেন।ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে মানুষ ক্ষমতার আসনে বসে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।একবারও ভাবছে না চলে যেতে হবে সব ছেড়ে ছুঁড়ে! তবে কেন এত ক্ষমতার অপব্যবহার! এই সুন্দর পৃথিবীতে উঁচুনিচু যে স্তর আমরা পর্যবেক্ষণ করি এতো বিধাতার সিষ্টেম।কিন্তু তারপরেও মানুষ হয়ে কি করে বিরাট বৈষম্যের পাহাড়িদেয়াল তৈরি করছে? মানুষ অমানুষিকতার পরিচয় দেচ্ছে।সহজ সরল বিষয়গুলো বিষাক্ত করে তুলছে।বরং সমাধানের পথ তৈরি না করে আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কুপথ সুগম করছে। কবি এই বিষয়টির প্রতি সাংঘাতিকভাবে মনক্ষুব্ধ হয়েছেন! নষ্টরাজনীতির চলমান  হালচাল কবি তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

অনিশ্চিত প্রহসনের ঘোলাজলঃ

মাল্টিন্যাশনাল মঞ্চগুলো আশীর্বাদ নেয় তলাবিহীন পলিটিক্সের
পোহায় অশ্রাব্য বচনে নিমজ্জিত সংসদীয় জানালার রোদ
উত্তাপিত নথিপত্র ঘুমায় লাল ফিতার গিঁট্টুতে।
.
কালো ফিতার আড়ালে দানা বাঁধে তিক্ত কোলাহলের স্তুপ
একাল ডুবে থাকে আকাশচুম্বী দুঃখ বিষাদের নাটক

বাহ! কী সুন্দর কবিতা! মাৎস্যনীতিবিদ্যার ফুলঝুরি ঝরিয়েছেন কবি তাঁর এই কবিতায়। নষ্টদের অপকৌশলের বীজ প্রোথিত করার আকাশ উন্মুক্ত করেছেন দিবসের আলোর মতো।এদিক থেকে  ভাবলে বোঝা যায় কবি আসলেই অপরাজনীতি  সচেতনার কবি।নষ্ট অন্ধরাজনীতির ঘোরতর বিরোধী। চলমান সমাজ সংসার যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার মুখোশ উন্মোচিত করেছেন।এদিক থেকে চিন্তা করলে অনায়াসে বলা যেতে পারে কবি এখানেই সার্থকতার নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন।তবে আরেকটি কথা না বললেই নয়- সেটি হলো কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কাব্যগ্রন্থের একটা আভাসগন্ধ নাসারন্ধ্র ছুঁয়ে যায়। কিশোর কবি যেমন রাজনীতি সংক্রান্ত কবিতার ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন তেমনি কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগও তাঁর ধারাবাহিকতার সারথি হয়েছে যেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।কেননা অপরাজনীতির ছোঁয়াচে রোগে একটি জাতি কিভাবে ধ্বংস এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কবি সে বিষয়টির নাড়িনক্ষত্র সার্থক শব্দচাষের মাধ্যমে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনেছেন।অর্থাৎ চলমান সমাজের রীতিনীতি, প্রথা, বিধিবিধান এবং সংস্কারের প্রতি কবি প্রচন্ডভাবে ক্ষেপেছেন।তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তায়,মৌলিকত্বে এবং কাব্য কলাকৌশলের মাধ্যমে বলিষ্ঠ হুঙ্কারই ছুঁড়েছেন।সেদিক থেকে তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা সমীচীন নয় কী!

ঘোরলাগা নিষিদ্ধ ছায়াঃ

তালা ঝুলে আছে মহাকালের পৃষ্ঠায়
দোআঁশ বাংলায় বাসা বেঁধেছে কীট

নীতিকথার বাঁকে দূরাগত বিভাজনের রক্তচোখ
পাথর চাপা দিয়ে রাখে - নাগরিক ঘিলু
যেন মগজ- ধোলাইয়ের সুগভীর মন্ত্রপাঠ
(কবিতাংশ)

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের  কথা মনে পড়ে গেলো। তিঁনি বলেছেন, "অল্প কথায় কাজ হইলে বেশি কথার প্রয়োজন কী?" সহজ, সরল,প্রাঞ্জলতাগুণ সম্পন্নকরণে যদি সাবলীলভাবে হৃদভাব প্রকাশ করে বোঝানো যায় রচনার কথা, কাব্য কবিতার কথা তাহলেইতো সেটাই বড় কাব্যিকতাময় শিল্পগুণ। কবি তাঁর ঘোরলাগা নিষিদ্ধ ছায়া কবিতায় শাষক-শোষকগোষ্ঠীকে চোখে বুড়োআঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন অদৃশ্য ট্রাজেডির স্পটে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কিভাবে তারা প্রতিনিয়ত বিষপিষ্ট করে প্রাণিকুলসহ সবুজদিগন্তকে ভস্মীভূত করে তুলছে! কবি এখানে তাঁর সাহসিকতার দৃষ্টান্তই রেখেছেন।আরেকটা বিষয় দিবসের আলোর মতো দৃশ্যমান সেটা হলো বৈষম্যের বেড়াজালে আটকে গেছে আমজনতার বাকস্বাধীনতা তথা স্বদেশের ভূমি,বৃক্ষসহ তরুলতা। যেটা প্রতিহত করা হলে গনতন্ত্রের স্বজন পরিজনের চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানুষ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়,জাতি হয়ে পড়ে বড্ড বেপরোয়া আর মুমূর্ষু! না জানি কখন কী হয়ে যায়!বিদ্যাপতির কথা বেমালুম ভুলে যায়- সবার উপরে মানুষ বুঝি সত্য নয়, সত্য হলো ক্ষমতার কলকব্জা!জাতির মাথা যদি কাটা পড়ে তাহলে শরীর থেকে লাভ কী!বুদ্ধিমত্তা থাকা না থাকাতো পরের কথা!সাংবিধানিক স্বাধীনতা বুঝি বেহেস্ত গেছে।নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত মস্তিষ্কে উপর কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগ চরমভাবে ক্ষেপেছেন।এখানে কবির আক্ষেপের বিষয়টি অগ্নিশিখার মতো, কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার লেলিহান শিখার মতো  গনগন করে ফেটে পড়েছে।এ যেন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব-ই না!তাঁর সাহসিকতার দৃষ্টান্তরই ছাপ রেখেছেন কবিতায়।

আগে মানুষঃ

মাতাল কোলাহল সমস্ত গোলার্ধে
জনতার অনুভবে ক্রমশ ক্রন্দন
জীর্ণ কুটির থেকে সভাসদ শোকের মিছিল
.
বিচিত্র নাগরিক দেয়ালে যে গড়ে উচ্চতম পাহাড়
তার নাম সত্য সাধক তার নাম কবি
যিনি মানুষ
অতএব, আগে মানুষ হই।

কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগের ভাবনার জগৎটাই যেন আলাদা ধাচের, সাম্যবাদের,বৈষম্যহীনতার ছকেবাঁধা।বিদ্রোহী কবি এমনকি কিশোর কবির মতন একস্বাতন্ত্র্যবোধের একচ্ছত্র উজ্জ্বল অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ ;আধুনিককালের এক প্রতিবাদী বিপ্লবী  উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। কবি তাঁর কবিতায় চলমান জীবন বাস্তবতার কথা,অসঙ্গতির চালচিত্রের কথা, দুঃখ কষ্টের কথা, মানস হৃদয়ের হাহাকারের কথা,সভ্যতার সংকটের কথা কী চমৎকারভাবে-ই না কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।তাঁকে মানবতাবাদী কবি বলা যেতে পারে।একবিংশ শতাব্দীর শ্রান্তক্লান্ত পাণ্ডুলিপির অপলক শুধু চেয়ে থাকা তাঁকে স্পর্শ করেনি।তিনি বাংলার মানুষের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের কথা অপরিসীম সাহসিকতার সাথে কাব্যময়ের বলিষ্ঠ উচ্চারণের সাথে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।জীবন যে কতোটা দুর্বিষহ, জীবন যে কতোটা যন্ত্রণার,জীবন যে কতোটা এখনো পরাধীন, জীবন যে কতোটা নিরুপায় হয়ে আছে অদৃশ্য অপশক্তির ইশারাতে কবি নির্দ্বিধায় তা প্রকাশ করেছেন তাঁর এই কবিতায়।সেই পশুত্বরূপী মানব জানোয়ারদেকেই তিনি মনুষ্যত্ববাদীতার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।

মেঘাচ্ছন্ন বাংলার আকাশঃ

মেঘাচ্ছন্ন বাংলার আকাশ
প্রতিনিয়ত ভিজছে জমিন,কাঁদছে মানুষ
অপকীর্তির প্রকোপে-
.
আমাদের রাজনীতি ডুবে গেছে
মরে গেছে কাঙ্ক্ষিত মননের নির্যাস
অযাচিত বিদ্রুপ -
(কবিতাংশ)
কবি অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে কবিচেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায়।ছত্রিশ হাজার বর্গমাইলজুড়ে আজ কতোটা অশান্তির মধ্যে,হৃদয়ক্ষরণের মধ্যে,হতাশা-বিষন্নতা-নৈরাশ্যের মধ্যে নিমজ্জিত আছে তিনি  তা কাব্য ও শিল্পসাধনার মাধ্যমেই প্রকাশ ঘটিয়েছেন।কবি তাঁর বিপ্লবী ছকের মধ্যে এনেছেন বাংলার তিক্ততামিশ্রিত প্রেম আর ভালোবাসা, সমাজনীতির অসঙ্গতির কথা, বীভৎস কদাকার নোংরা মানসিকতা রাজনীতির কথা ইত্যাদি।কবি এ সমস্ত অনৈতিকতাকে উতরিয়ে মানবিক প্রেমের জয়গান গেয়েছেন, প্রশান্তির খোলা দিগন্তের কল্লোলিত রূপের ঝলকানি চেয়েছেন, হিংসাত্মক নৈরাজ্যতার রাজনীতির রেষারেষি মিমাংসা চেয়েছেন।কবি তাঁর কাব্যে বাংলার জমিন ভেজাতে চেয়েছেন প্রেম, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, পরস্পরের মানবিকতা; কবি রক্ত চায়নি, চায়নি বাংলার মায়ের আহাজারি রোনাজারি। শুধু চেয়েছে মানবিকতার এক স্বর্গরাজ্য; যা কবি চেতনার এক বিরাট অর্জন।

যাইহোক আলোচনা দীর্ঘায়িত না করি। কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগের  'শপথ ভাঙার ইশতেহার' কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা এক একটি বুলেট।অত্যন্ত সহজ, সরল, সাবলীল ভাষার প্রকাশ করে তিনি কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছেন।গ্রন্থটির ভাষায় কোনোপ্রকার জটিলতা বা আড়ষ্টতা লক্ষ্য করা যায়নি।আশা করি পাঠক বইটি পড়ে অনেক উপকৃত হবেন। ডিজিটাল উত্তর বাংলার বিভিন্ন অনিয়ম, অসঙ্গতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, হিংসা প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি, রীতিনীতি, সমাজনীতি তিনি তাঁর কাব্যময়তার মাধ্যমে অত্যন্ত শিল্পসমৃদ্ধ করে তুলেছেন।' শপথ ভাঙার ইশতেহার'কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাতে তিঁনি সুন্দর সুন্দর ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, সাম্যবাদসহ আছে মানবিকতার বিশুদ্ধ উচ্চারণ। আসলে কবির এই কাব্যগ্রন্থকে নষ্টরাজনীতি বিশ্লেষণের হাতিয়ার বলা যেতে পারে এবং কবি শফিকুল ইসলাম সোহাগকে নিঃসন্দেহে রাজনীতি বিশ্লেষণের কবি বলা যায়।