সোমবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ২৫ ১৪৩১

ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণ

মো. সাইদ মেহেদি

প্রকাশিত: ২১:১১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণ

মো. সাইদ মেহেদি

ব্রিকস হল উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট। সবশেষ ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তর্ভুক্ত হবার পূর্বে এই সঙ্ঘটি "ব্রিক" নামে পরিচিত ছিল। মূলত উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ উর্ধ্বমুখী। সেইসাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর উপর তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তাই এই জোটকে বেশ প্রভাবশালী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ব্রিকস একটি বহুজাতিক সংস্থা। এই জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভৌগলিক নৈকট্য, অর্থনৈতিক কাঠামো বা সাংস্কৃতিতে বড় ধরণের ফারাক আছে। প্রতিবেশী হলেও চীন ও ভারতের সম্পর্কও বেশ জটিল।

এবারের ব্রিকস সম্মেলনটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। তার কয়েকটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। একটি কারণ হলো- ব্রিকস সংগঠনটি কয়েকটি জনবহুল দেশ- চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। ভারত এবং ব্রাজিলও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে চীনের অবদান ১৯ শতাংশ। ভারতের অবদান প্রায় ৩ শতাংশ। এই দুটো দেশের বিশ্ব অর্থনীতিতে ২২ শতাংশের মতো অংশগ্রহণ আছে। কাজেই জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনটি ব্রিকসের ১৫ তম সম্মেলন। এর আগে অনুষ্ঠিত ১৪টি সম্মেলন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এতে করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর প্রেক্ষাপটে ডলার আধিপত্য হ্রাস এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে ব্রিকস নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বস্তুত ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবী মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা জগত রাশিয়ার ভূমিকা নিন্দা করে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করে ইরান, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, নিকায়ারাগুয়ার মতো দেশগুলো পশ্চিমাদের ভূমিকাকে নিন্দা করছে। এর পাশাপাশি চীন-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-ব্রাজিলসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ এক্ষেত্রে পশ্চিমা জগত ও রাশিয়া থেকে সম-দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

১৫ তম ব্রিকস সম্মেলন মূলত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার একটি হলো, পশ্চিমা বিশ্ব তথা ডলারের প্রভাব কমিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বিকল্প কাঠামো তৈরি করা এবং সে সঙ্গে ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতির কাঠামোতে একটি নতুন মেরুর সঞ্চার করা। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, ব্রিকসের এ প্রচেষ্টা অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে বিকল্পধারা তৈরি করার চীনা প্রচেষ্টার সঙ্গে অনেকটাই সাজুস্যপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন। ফলাফলের দিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে সফল সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ ছয়টি নতুন দেশকে এ সংস্থার সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। এ ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা থেকে দুটি দেশ- মিশর এবং ইথিওপিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তিনটি দেশ- ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকে একটি দেশ- আজেন্টিনা এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এলডিসি সদস্যভুক্ত দেশ ইথিওপিয়ার অন্তর্ভুক্তি খানিকটা প্রশ্নের উদ্রেক করলেও অনেক বিশ্লেষক আফ্রিকার একাত্মতা এবং ব্রিকসের এবারের সম্মেলনের মূল বক্তব্য- ব্রিকস এবং আফ্রিকার মধ্যে পার্টনারশিপের অনুপ্রেরণাতেই তেমনটা ঘটেছে বলে মনে করেন। অপরদিকে আর্জেন্টিনা বাদে অপর দেশগুলো তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ভূ-কৌশলগত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে কাজ করে থাকবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ল্যাটিন আমেরিকার ভৌগোলিক বিবেচনায় আজের্ন্টিনার অন্তর্ভুক্তি হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

এই জোটের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হল তাদের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু জোটের সব দেশগুলোর মধ্যে কতটা ঐক্যমত্য রয়েছে তা খুব জরুরি। বিশেষ করে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন বা নিজস্ব রিজার্ভের মতো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে সেগুলো কেবল প্রস্তাবনা আকারেই পড়ে থাকবে। বাংলাদেশের ব্রিকস সম্মেলনে যোগদান এবং সদস্যপদ পাওয়া - না পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা রয়েছে তবে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেসকল বিষয় তাঁর ব্রিকস সম্মেলনে যোগদান পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেছেন।  ব্রিকসের সদস্যপদ এখনই পেতে হবে এমন কোনো চিন্তা বাংলাদেশের ছিল না বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এখনই সদস্যপদ পেতে হবে সে ধরনের কোনো চেষ্টাও করিনি। চাইলে পাব না সে অবস্থাটা নেই।’ দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটা কাজের একটা নিয়ম থাকে। আমরা সে নিয়ম মেনেই চলি। আমার সঙ্গে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হলো, আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ব্রিকস সম্মেলনে। তখন আমাকে এও জানালেন তারা কিছু সদস্যপদও বাড়াবেন। সে বিষয়ে আমার মতামতও জানতে চাইলেন। আমি বললাম এটা খুবই ভালো হবে।’ তিনি সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, ‘ব্রিকস যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এ পাঁচটি দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ সবসময় ছিল এবং আছে।

তবে এই মুহূর্তে ব্রিকসের নেতারা যে ধরনের কথাবার্তা বলছেন সেই কথাগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে খুব ইতিবাচক ঠেকবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে তার যুদ্ধের পক্ষে যে সাফাই গেয়েছেন সেটি পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে চীন ও ভারত সরাসরি রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী করেনি এবং নিন্দাও জানায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকাও একই অবস্থান গ্রহণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক যে ঘটনাপ্রবাহ তৈরি হচ্ছে সেসব বিষয়ে ব্রিকসের অবস্থান পশ্চিমাদের খুব খুশি করবে তেমনটা মনে হয় না।তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের ধারণা,  যদি বাংলাদেশ এবার  ব্রিকসের সদস্য হতো সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্রিকসের উল্লেখিত রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হলে সেটা পশ্চিমাদের চাওয়ার বিপরীতমুখী হতে পারতো। কিন্তু ধারণার ওপর ভিত্তি করে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। হয়তো জোটভুক্ত হলেও পশ্চিমা দেশগুলো সুসম্পর্ক বজায় রাখতো। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশ বাজার মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নির্ভর। বিনিয়োগও ওইসব দেশ থেকেই বেশি আসে। তাই জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চিমাদের চাপে পড়তে পারতো এমনটি অনুমান করা স্বাভাবিক। তবে ব্রিকস জোটের অধীনে গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ শুরু থেকেই বাংলাদেশের ছিল এবং বাংলাদেশ ওই ব্যাংকের সদস্য হয়েছে।

ব্রিকসের সদস্য বাংলাদেশ না হওয়া প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করলে দুটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হবে। প্রথমত, ব্রিকসে নতুন সদস্য রাষ্ট্রের তালিকা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ব্রিকসে নতুন করে যেসব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে ইথিওপিয়া ছাড়া বাকি সবাই এলডিসির ওপরে উন্নয়নশীল দেশ। সে বিবেচনায় হয়তো তারা বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেনি। দ্বিতীয়ত, সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে হয়ত প্রথমদিকে বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছি কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন তা যথাযথ হয়েছে কিনা সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য না হওয়া সরকারের সফল কূটনীতিক জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিবেচনায় বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হলে তা বাস্তব অর্থে আমাদের জন্য খুব একটা পরিবর্তন আনতো বলে মনে করি না। তার কারণ হলো, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্রিকসের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চীন এবং ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক মোটামুটি ভালো। যেহেতু ব্রিকসের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জোরালো কোনো অর্থনৈতিক যোগাযোগ নেই সে কারণে ব্রিকসের সদস্য এ মুহূর্তে না হওয়ায়  বাংলাদেশের ক্ষতির তেমন কারণ আছে বলে মনে করি না।

লেখক : গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী