সোমবার ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ২৫ ১৪৩১

তাসের ঘর

কামাল কাদের

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ১২ মার্চ ২০২৪

তাসের ঘর

ছবি- সংগৃহীত

পৃথিবীতে সব সময়ে নারীর সৌন্দর্যের এবং রূপের জয়-জয়কার। সেটা অনাগত কাল থেকেই। এটা সত্যি ,যে কোনো নারীর রূপ হলো তার গর্বের বিষয়। তাইতো সাধারণ মহিলারা রূপবতী মহিলাদের সৌন্দের্য্যে ঈর্ষা কাতর হয়ে পরে। কিন্তু এই রূপই রুবিনার জীবনে কাল হয়ে উঠবে সেটা রুবিনা কিংবা তার পরিবারের কেউ ঘূর্ণাঅক্ষরে আঁচ করতে পারে নাই। ভাগ্যের লীলা -খেলা বলতে হবে।

রুবিনার উঠতি যৌবনের রূপের সৌন্দর্য এতই প্রখর ছিল যে , পাড়া প্রতিবেশী থেকে যে কোনো মানুষ সেটা পুরুষ অথবা মহিলা যে কেউ হউক না কেন ,তার দিকে একবারের বেশী দুবার না তাকিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারতোনা। স্কুল জীবন থেকেই সমানে বিয়ের প্রস্তাব আসা যাওয়া করছে। ফলে মেয়েকে ঘরে রাখা রীতিমতো রুবিনার বাবা মার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রুবিনা যখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পরে তখন সে তার এক বান্ধবীর সাথে তাদের শহরের এক মেডিকেল কলেজের বার্ষিকী নাটক দেখতে যায়। সেখানে এক ডাক্তার দম্পতী রুবিনার রূপ দেখে তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে , " এই মেয়েকে আমাদের পুত্র বধূ করতে হবে । " যেই ভাবা সেই কাজ। ফাংশন শেষ হবার পর তৃতীয় পক্ষের সহায়তায় রুবিনাদের বাসার ঠিকানা জোগাড় করে নিলো। একদিন ভালো সময় ক্ষন দেখে ডাক্তার দম্পতী রুবিনাদের বাসায় তাদের ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির। এবার নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ের বাবা মা এই প্রস্তাবে না করা তো দূরের কথা,বরং হাতে যেন চাঁদ পেলো। পাত্র ডাক্তার ,পাত্রের মা বাবাও ডাক্তার।প্রচুর বিষয় সম্পত্তি , এতো সোনায় সোহাগ। যথা সময়ে বিয়েটা হয়ে গেলো।

বিয়ের দিনটি আজও রুবিনার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভেসে আসছে। ভেসে আসবেনা কেন ? মেয়েদের জীবনে এ যে পরম পাওয়া। সব মেয়েরই আশা থাকে এ দিনটির জন্য।সে দিনটি ছিল জোস্না ভেজা রাত। যাকে বলে কাক জোস্না। চাঁদের আলোয় সমস্ত আকাশটাকে ভরিয়ে দিয়েছে। একটা সুচ মাটিতে পরে থাকলেও খুঁজে বের করে নিতে কষ্ট হবেনা, এতই ছিল সে আলোর প্রখরতা । এমনই দিনে ডাক্তার বাশার নিজের মালিকাধীন এই নব নির্মিত ফ্লাটটিতে নিয়ে এসেছিলো রুবিনাকে বধূ করে । রুবিনার বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। রোমাঞ্চ ,কল্পনা ,ভবিষ্যৎ সব কিছু মিলিয়ে এক দুর্বার আশা নিয়ে আর পাঁচ জন নারীর মতো একটা ছোট্ট সংসার গড়তে চেয়েছিলো । কিন্তু আজ সে আশা দুরাশায় পরিণীত হয়ে রইলো । বিয়ের দিন সারা রাত দুজনে প্রেমের আবেগে জেগে কাটিয়ে দিলো। বিয়ের পরদিন রুবিনা দেখতে পেলো মাঝ রাতে বাশার হাউ মাও করে কেঁদে উঠছে ,আর কপাল দিয়ে ঘরের দেয়ালে জোরে জোরে প্রচন্ড আঘাত করে যাচ্ছে। রুবিনা বাশারের সামনে গিয়ে দেখলো তার কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। কপালের রক্ত পরিষ্কার করে তাকে কোনোমতে ধরাধরী করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর বাশার অচেতন অবস্থায় গভীর ঘুমে নিমজ্জীত হয়ে গেলো। পরদিন সকালে রুবিনা যখন বাশারকে তার গত রাতের অস্বাভাবিক আচরণের কথা জিজ্ঞাসা করলো , তখন সে কিছুই মনে করে উঠতে পারলো না। যখন রুবিনা তার কপালে কেটে যাওয়ার দাগটা আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দেখালো ,তখন বাশার ছোট্ট উত্তর দিলো, " ও ,কিছু না , এরকম দাগ আমার কপালে আগে থেকেই ছিল ,ওটার জন্য তুমি কিছু ভেবোনা। "

প্রত্যেক দিন গভীর রাতে এ রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলছে। মাঝে মাঝে রুবিনা ভয় পেয়ে কুঁকড়িয়ে উঠে ,কি করবে ভেবে পায়না। কয়েকদিন পর সে তার এই বিরূপ অভিজ্ঞতা শশুর --শাশুড়িকে জানালো। শাশুড়ি কথাটি শুনে রুবিনাকে অবাক করে বললো ," বাশারের একটু মানসিক সমস্যা আছে , সময়ের সাথে ওটা চলে যাবে। " তার মানে রুবিনার শশুর বাড়ির লোকেরা জেনে শুনে এরকম এক মানসিক বিকার গ্রস্ত লোকের সাথে তাকে বিয়ে দিয়েছে। সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় এই যে বাশার নিজেও একজন ডাক্তার। সে কেন এ কাজটা করতে গেলো ? দিনের বেলায় বাশার সম্পূর্ণ ভাবে সাধারণ ভদ্র লোকের মতো ব্যবহার করে ,সত্যিকারে এক প্রেমিক হিসেবে ,রাত গভীর হতে থাকলে তার রূপ বদলাতে থাকে। সময় সময় ভীষণ উছশৃংখল হয়ে যায়। সে আলাহ্কে দোষারুপ করে ,আল্লাহ কেন তাকে এ দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দিলো। রুবিনা পরে আরো জানতে পারলো বাশার একজন schizophrenia রোগী। এর কোনো ফলপ্রসূ চিকিৎসা নেই। এই সমস্ত রোগীদের একটা বদ্ধ ধারণা তারা চারিদিক থেকে নানা রকম কণ্ঠস্বর ,আদেশ এবং সুর মিলানো কথা শুনতে পায়। তারই প্রতিফলনে এই সমস্ত রোগী অপকর্ম করে চলে। এই সমস্ত রোগীরা তার চারিপাশের লোকদের কি অসুবিধা অথবা কষ্ট হচ্ছে তার কোন খেয়াল রাখে না বা রাখার মতো তাদের মস্তিস্ক তখনকার মতো কাজ করে না। ঘোর পার হয়ে গেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়, পাছে কি ঘটে ছিল ,কিছুই মনে করে উঠতে পারে না। চিকিৎসা বিদ্যায় এটাকে মতিভ্রম বা ভ্রান্তিজনক মনকে অন্য জগতে বিচরন করে বলে ধারণা করে । তাদের ব্যবহার কখন কখন খুবই অমায়িক হয় ,কখনো সংকটময় আবার কখনো গালা গালির পর্যায়ে চলে আসে।

রুবিনা কি করবে ! কি বা করার আছে । গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছে ,উপরন্ত লেখাপড়ার দৌড় ও বেশিদূর আগাইনি। কি যে করবে কিছুই ভেবে পায় না। তীর বাঁধা পাখির মতো জীবনটা চালিয়ে নিতে হবে ,এছাড়া আর কোনো পথ সে খোলা দেখছেনা। খুব বেশী হলে ডিভোর্স নিতে পারে। তাহলে বাকী জীবনটা কি সে একাকী কাটিয়ে দিবে ?। সে তার রূপকে এই জঘন্য জীবনের জন্য দায়ী করলো। তার এতো অঙ্গে এতো রূপ না থাকলে হয়তো আর সাধরণ মেয়ের মতো জীবনটা চলে যেত। অন্য কোনো উপায় না দেখে সমাজের ভয়ে ,জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে সংসার চালাতে মনস্থির করলো। সে অনেক মানসিক যাতনায় ভুগতে শুরু করলো। সে বুঝতে পারলো এই পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য নয়। সবাই নিজের কুৎসিত স্বার্থ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হিংসা ,সন্দেহ-প্রবণতা ,লোভ -লালসা ,পক্ষপাতিত্ব ,অনুশোচনা জড়িত ঘৃণা এবং দুর্বলদের প্রতি সবলদের অত্যাচার ক্রমেই বেড়ে চলছে।

নানা ঘাত- প্রতিঘাতে জীবন চলে যাচ্ছে। বছর খানিকের মধ্যে রুবিনা এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা হলো। জীবনটাকে নুতন করে ভালোবাসতে শুরু করলো। ভাবছিলো ছোট্ট মা মনিকে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিবে। তা আর হলো না। ছোট্ট সুজি ( সুজাতা ) এক দুর্লভ ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হলো। ইংরেজিতে ওই অসুখটার নাম হলো juvenile myelomonocytic blood cancer ,যার চিকিৎসা বাংলাদেশে নাই। বড় লোকের নাতনি ,চিকিৎসার জন্য টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। আধুনিক চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হলো। কয়েক মাস ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা করার পরে ও সুজিকে বাঁচানো গেলোনা। মৃত্যুর খবরটা জেনে বাড়ীর অন্যাণ্য সদস্যের তুলনায় রুবিনা একেবারে ভেঙে পড়লো। পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করলো আর বলে চললো ," " মা মনি ,তোমাকে হারিয়ে আমার জীবনে আর সে রকম জীবন আসবেনা। তুমিই বলো আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকি ! " সে খোলা আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে সুজির উদ্দ্যেশে বললো , " হে আমার প্রিয় , তুমি যেখানেই থাকো ,ভালো থাকো। আমার জীবনের সমস্ত আশা, স্বপ্ন তোমার অনুপস্তিতে বিধস্তত হয়ে গেছে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি ,তুমি আমার হৃদয়ে সব সময়ে বেঁচে থাকবে এবং আমার জীবনভর তোমাকে আমি আমার স্মৃতিতে অক্ষয় করে রাখবো।আমি অনেক আশা করেছিলাম তুমি আমার সাথে এই পৃথিবীতে অনেক দিন ধরে থাকবে,কিন্তু এই পৃথিবী তোমার জন্য ছিলোনা। আমি তোমাকে কত ভালোবাসি সেটা বলে বোঝানো যাবেনা ,কারন এ কথা ভাবতে গেলে বুকটা ব্যাথায় ভরে উঠে। তোমার জন্য আমার সর্বাঙ্গ ব্যথায় ছটফট করে ,কিন্তু যখন আমি আমার চোখ বন্ধ করি তখন অনুভব করতে পারি তুমি আমার হাতটি ধরে আছো। তোমার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ ,অনুগ্রহ করে তুমি তোমার মার এই হাতটি চিরজীবনের জন্য সজোরে ধরে রাখো ,ছেড়ে দিওনা। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না ,বরং প্রতিদিন ,প্রতিমুহূর্ত বেড়ে চলবে। হে আমার সাহসী তারকা ,তুমি শান্তিতে ঘুমাও !কেউ তোমাকে বিরক্ত কোরবেনা। "
রুবিনার এই অসংলগ্ন কথা বার্তা শুনে বাড়ীর সবাই ভাবছে ,রুবিনা তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। হয়তোবা তাই , অথবা না। আসলে রুবিনার কষ্টে সৃষ্টির সংসারটা এমনি করে তাসের ঘরের মতো জীবন জোয়ারে ভেসে গেলো, এটা তারই প্রতিক্রিয়া।