শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, আশ্বিন ২০ ১৪৩১

আকাশ পাড়ে মেঘের খেলা

কামাল কাদের

প্রকাশিত: ২২:২৩, ২৫ মে ২০২৪

আকাশ পাড়ে মেঘের খেলা

ছবি- সংগৃহীত

এ পৃথিবীতে কেউ জীবনের আঘাত থেকে পরিত্রান পায় না। আমরা সবাই কম বেশী আঘাতের সাথে জড়িত। সেটা শারীরিক ,মানসিক অথবা আধ্যাতিক যে কোনো বিষয়ে হতে পারে। অনেক সময়ে শারীরিক বেদনার চেয়ে মানসিক বেদনা ভীষণ কষ্টদায়ক হয়ে উঠে। যেমন সন্তানকে , মা -বাবাকে , স্বামীকে অথবা স্ত্রীকে হারানো। আবার কখনো বিবাহিত জীবন ভেঙে যাওয়া অথবা চাকরী হতে বরখাস্ত হওয়া , এমনকি কোনো আকাঙ্খিত সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ফলে আমরা মানসিক যাতনায় ভুগি । নানা রকম অসুখ - বিসুখ তো রয়েছেই। দুঃখ আছে ,বেদনা আছে এ নিয়েই আমাদের জীবন চলছে । এটাই হলো নিয়তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ।


সেলিম দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি তার আচার ব্যবহার সবার কাছে চোখে পড়ার মতো । সে ছোট বেলা থেকেই বাবা মাকে হারিয়েছে। বাবার কথা তো মনেই পড়েনা , মাকে হারানোর পর তার ছোট্ট জীবনটা গৃহ হারা হয়ে গেলো। তখন সেলিমের বয়স ৮ /৯ বছর হবে। কোথাও যাওয়ার বা থাকার জায়গা রইলোনা। রাস্তায় রাস্তায় রাত দিন ঘুরে বেড়ায়। হাতে কোনো পয়সা নাই , মন চায় একটা কিছু করতে। বিশেষ করে লেখাপড়ার প্রতি তার ভীষণ আকর্ষণ। কিন্তু তার এই ছন্নছাড়া জীবনে লেখা পড়ার কথা চিন্তা করা তার পক্ষে এক দুর্গম পর্ব্বত অতিক্রম করার মত সমতুল্য। এতটুকু বয়সে সে জীবন যুদ্ধে নামতে বাধ্য হলো। তার অদম্য সাহস, অধ্যবসায় এবং মনোবলের ফলে সে একে একে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে লাগলো।এ যেন এক অকল্পনীয় কাহিনীর মত।


সে ঢাকা শহরের এক ছোট খাটো মোটর গ্যারেজের মেকানিক সাহেবের হেলপার হিসাবে কাজ শুরু করলো এবং কাজের বোনাস হিসাবে উপর তলায় অন্যাণ্য স্টাফদের সাথে ফ্রি থাকার সুযোগ পেলো। দিনের বেলায় সে গ্যারেজে কাজ করে আর সন্ধ্যাবেলায় নিকটবর্তী এক ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস করে। সারাদিন গ্যারাজের কাজ করে সন্ধ্যায় পড়াশোনা করা, স্কুলে যাওয়া তার পক্ষে অনেক কষ্টদায়ক ছিল ,তবুও সে হাল ছাড়েনি। বেতন যা পাওয়া যেত ,তা দিয়ে কোনোমতে দিন চলে যেত। কখনও মাস শেষ হওয়ার আগে টাকা পয়সা ফুরিয়ে গেলে শুধু পানি খেয়ে দিন চালিয়ে নিত এবং সেই ক্ষুধা নিয়ে সে স্কুলে ক্লাস করতে যেত। দেখতে সুদর্শন , ফলে সুন্দর কাপড় চোপড় পড়লে তাকে ধনী ছেলের মতো মনে হতো। তাইতো মাঝে সাঝে কোনো দিন শহরের কোনো বিয়ে বাড়ীর অনুষ্ঠান দেখলে ঢুকে পড়তো ,কেউ জানতে বা বুঝতে পারতোনা সে কোন দলের । একবেলা একটু পেট ভরে ভালো খাবার খাওয়া হয়ে যেত। সেই সময়ে যদিও তার পক্ষে অন্য সব মানুষের মত সাধারণ জীবন যাত্রা চালানো কঠিন ছিল ,তবুও সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল , " আমাকে যেমন করে হোক লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে "।


এভাবে কষ্ট করে সে HSC পাস করলো। গ্যারেজে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা নামি এবং দামী রেস্টুরেন্টে ম্যানেজার হিসেবে চাকরী পেলো।আর তার সাথে যথারীতি সন্ধ্যাকালীন বি ,এ, ক্লাসের পড়াটা চালিয়ে যেতে লাগলো। সময় মত সে বি ,এ ,পাশও করলো। রেস্টুরেন্টের মালিক আহমেদ সাহেব সেলিমের কাজ কর্মে ভীষণ খুশি এবং তাকে ডিপ্লোমা -ইন -হোটেল এন্ড কেটারিং কোর্স করার জন্য উৎসাহ দিলেন। সেলিম ভাবলো এরকম একটা প্রফেশনাল কোর্স অর্জন করতে পারলে সে তার এই জীবনটাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে পারবে।


আহমেদ সাহেবের রেস্টুরেন্টি ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কাছেই । একদিন দুপুরে লাঞ্চের সময় এক সুন্দরী যুবতী রেস্টুরেন্টের ভিতরে এসে সেলিমকে রিসিপশনে বসে থাকতে দেখে বললো ," আমি এই বিশ্ববিদালয়ের ছাত্রী এবং এই মুহূর্তে আমার কাছে একটি পয়সাও নেই। আমার হ্যান্ডব্যাগটি এক ছিনতাইকারী নিয়ে ভৌ দৌড় ", এই বলে যুবতীটি কাঁদতে শুরু করলো।মেয়েটি সত্যি বলছে কি মিথ্যা বলছে সেটা যাচাই না করে সেলিম তাকে অতি যত্ন সহকারে একটা খালি সিটে বসিয়ে এক কাপ চা দিল। তারপর তাকে আশ্বস্ত করে বললো ," আপনি মোটেই ঘাবড়াবেননা। এরকম ঘটনা আজকাল হরহামেশাই হয়ে থাকে , সুতরাং এ ঘটনা মন থেকে মুছে ফেলুন। " এই বলে সেলিম তার এক ওয়েটারকে ডেকে বললো ," মেম সাহেবকে দুটো ডিমের স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে দাও। "


খাবার শেষ করার পর মেয়েটি সেলিমের দয়ার সুযোগ নিয়ে তার সাথে অসংলগ্ন আচরণ শুরু করে দিল এবং স্বার্থপরের মত বিরক্ত করার চেষ্টা করলো । সেলিম মেয়েটির এরূপ ব্যবহারে হতবাক। সে ভাবলো তাকে এভাবে হয়রানির করার পিছনে নিশ্চয় একটা ইচ্ছা শক্তি কাজ করছে। কিন্তু এই ইচ্ছা শক্তির বাঁধ ভেঙ্গে যদি অতিরিক্ত খারাপ ব্যবহার শুরু হয়ে যায় তাহলে তো ভয়ের কারণ হওয়া স্বাভাবিক। গরীব ঘরের ছেলে, জীবনের দুঃখ কষ্ট অনেক কাছে থেকে দেখেছে ,তাই তো এ সমস্ত মেয়ে ঘটিত কোনো ঝামেলায় সে জড়াতে চায় না। তাহলে এই "ট্রমা " থেকে সে কিভাবে বেরুবে ? ভাবছে পুলিশ ডাকবে কিনা !


পুলিশ ডাকার আগেই মেয়েটি নিজেই বিষণ্ণ মনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। সেলিম ভাবলো ," যাক বাবা ,বাঁচা গেলো। " মেয়েটির এরূপ ব্যবহারে সে একটু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম ব্যবহার সচারচর ছেলেরা মেয়েদের পিছনে লাগার চেষ্টা করে ,মেয়েরা যে ছেলেদের পিছনে এ রকম নির্লজ্য ভাবে বিরক্ত করবে সেটা সেলিমের ধারণার বাইরে ছিল। এরপর ঘটনাটি সেলিম বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু এর সপ্তাহখানিক পর মেয়েটি সেলিমের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবরাখবর নিয়ে সমানে তাকে তার মনের ভাব ব্যক্ত করে ই-মেইল , টুইট ,ভয়েস -মেইল এবং চিঠিপত্র লিখে বিরক্ত করা শুরু করলো। আবার কখনও কখনও মেয়েটি রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষা করে সেলিমের সাথে একান্ত আলাপ করার সুযোগ খুজতে থাকে। সেলিম বুঝতে পারলো , সে এক মহা বিপদে পড়েছে। তাই একদিন মেয়েটিকে রেস্টুরেন্টের ভিতরে ডেকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলো," আপনি আমার পিছনে যে ভাবে লেগেছেন তাতে আমার চাকরী নিয়ে টানা টানি হতে পারে। তাছাড়া আপনার মতো একজন সুন্দরী, বিদুষী মহিলাকে এ রকম আচরণ করা সাজে না। "
মেয়েটি মুচকি হেসে বললো ," আপনাকে আমার ভালো লাগে , আপনার কাছের মানুষ হতে চাই এতে আপনার গ্রহণ করতে দ্বিধা কোথায় ? "
- ব্যাপারটা বিদঘুটে হয়ে যাচ্ছেনা !
- মোটেই না।
-আমি এক দরীদ্র ঘরের সন্তান , এ জীবনে আমি একা। চাল নেই , চুলো নেই। যাযাবরের মতো আমার জীবন। আপনার সাথে এরকম খেলার সাথী আমি হতে পারি না। অনুগ্রহ করে আপনার এই খামখেয়ালি চিন্তা ধারায় আমাকে জড়িত করবেন না।
- সত্যি বলছি ,আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।
- আমার মনে হয় আপনি psychopathic chracters' এ ভুগছেন। আপনাকে ডাক্তারের দেখানো প্রয়োজন।
- অসম্ভব , আপনার ধারণা অমূলক।
- কিন্তু আমি বদ্ধপরিকর আপনি একজন vulnerable মহিলা। আপনার এই অবাস্তব চিন্তাধারা এক প্রকার মানসিক রোগ।
- আপনি কেন আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ করছেননা । আমার ভালোবাসা আপনার প্রতি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ।
- আপনাকে আগেই বলেছি তো আমার অপারগতার কথা। আসলে আপনার মাঝে একটা উদ্ভট বা আজগবী চিত্র যা কল্পনা করার মত শক্তি রয়েছে যেটাতে আপনি আসক্ত এবং সেটা বিশ্বাস করেই আপনি আপনার জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। বিষয়টাকে আপনি যত বাস্তব মনে করছেন পারতপক্ষে সেটা সত্যি নয়। আমার মনে হয় আপনার বাবা মায়ের সাথে এ বিষয়ে আমার আলোচনা করা দরকার। কারণটা হলো শুধু আপনাকে এই মোহ থেকে বাঁচিয়ে তোলা নয় , আপনার চারি পাশে যে সমস্ত আপনার হিতাকাঙ্খী রয়েছে তাদেরকেও এই অবরোধ থেকে বাঁচিয়ে তোলা।
- নিশ্চয় আমার বাবা মার্ সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। তার আগে , একটিবার বলুন আপনি আমার শুভআখাঙ্কী এবং আমাকে ভালোবাসেন।
- নিশ্চয়ই আমি মনে প্রাণে আপনার মঙ্গল কামনা করি। আমি আপনাকে ভালোবাসি বা না বাসি সেটা আমি কেমন করে বলবো ?, এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। তবে বলতে পারি ,যে কোনো পুরুষই আপনাকে সাথে পেতে ইচ্ছা করবে।
- শুনে ভালো লাগলো। এখন বলুন আপনি কবে আমার বাবা-মার সাথে দেখা করতে আগ্রহী ?
- যখন বলবেন ,তখনই আমি প্রস্তুত। ভালো কথা আপনার নাম তো জানা হলোনা !
- বলার সময় দিলেন কখন। আমার নাম মোস্তারী জাহান ,প্রিয় জনেরা সুদীক্ষা বলে ডাকে। আপনিও আমাকে সুদীক্ষা বলে ডাকবেন, আমি ভীষণ খুশি হব।