জাপানের পথে পথে – (পর্ব-৩)
সেতাগায়া কু-এর বাড়িটি কিয়োকোর নিজের। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দোতলা বাড়ির উপর তলায় থাকেন। একা। নীচতলায় তাঁর ছোট বোনের সংসার। প্রফেসরের কোনো পরিবার নেই। এ প্রসঙ্গে কখনো জানতেও চাইনি কারণ তাঁর বদান্যতার ভিতরে এক ধরনের আবরণশীলতা লক্ষ্য করেছি, আবার ভয়ও পেতাম। তিনি এই স্কলারশিপের পেছনে কী যে শ্রম দিয়েছেন তা বর্ণনা করা কঠিন, ফলে আমার নিকট শিক্ষা বিষয়ে এতটাই প্রত্যাশা করতেন যে তার জোগান দিতে দিতেই ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। ফলে স্বল্পসময়ের সাক্ষাৎগুলোতে খুব প্রয়োজনীয় কথার বাইরে তেমন কিছুই বলা হতো না। একটি উদাহরণ টানি। একসময় আমি কাৎসুসিকা হোকসাইয়ের (১৭৬০-১৮৪৯) চিত্রের প্রতি খুবই আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম।প্রথমত তাঁর বাসা আস্ত একটা লাইব্রেরি ছিল। সেখান থেকে প্রতিদিনই দুচোরটে বই উল্টে পাল্টে দেখতাম। ভাষার প্রতিবন্ধকতার কারনে ইংরেজি বইগুলোই একমাত্র অবলম্বন ছিল। একদিন একটি বই পেলাম ‘৩৬ ভিউজ অব মাউন্ট ফুজি’ । অসাধারণ এক ছাপচিত্রের অ্যালবাম। আমার সুকঠিন ভাষা শিক্ষনের ব্রতের ভিতরও মাঝে মাঝে ছবি আঁকা চলে হোকসাই-এর উৎসাহে। আমি কিয়োকোকে কাৎসুসিকার প্রতি আগ্রহের কথা জানালে তিনি সবকিছু শুনে বললেন।
– ‘এই জাপানের শিল্পজগত অনেক বিশাল। ফলে তুমি এ বিষয়ে কিছু করতে চাইলে আগামীতে কোনো সময় এসো এই দেশে। এখন এ যাত্রায় তোমার সেইটুকু সময় নেই।’
কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে আমি ততটা করিৎকর্মাও ছিলাম না তখন। আমার সংগীতের প্রতি ভক্তি কিংবা জ্ঞানান্বেষণে গভীর আগ্রহ ছিল অশেষ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অপরিপক্কতা, অথবা ভাষাগত বাধা এসবের প্রতি প্রেম কম ছিল, এটাই উপলব্ধিতে এসেছিল তখন। এর আরেকটি প্রধান কারণ আমাদের শিক্ষা পরিসর কোনোভাবেই এই ধরনের শিক্ষাবিদ্যার ধাতে অভ্যস্ত নয়। আমরা যে ধরনের সংগীত চর্চা নিয়ে বেড়ে উঠেছি তা দিয়ে সংগীতের উচ্চতর গবেষণা সম্ভব নয়। (তবে এ বিষয়ে অন্যত্র বিস্তারিত বলা যাবে) । যাই হোক, সাকুরা ১-২-৮, সেতাগায়া-কু-এর বাসায় একা একা থাকতে হবে তিন সপ্তাহ মতো । দুপুরের ভোজন সেরে কয়েকটা বাসাভাড়ার দেয় এমন কয়েকটি অফিসে গেলাম। কিন্তু বুঝলাম যে টোকিও শহরে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া আমার স্কলারশিপ কনফারমেশন হয়েছিল জাপানে আসার মাত্র ১৩ দিন আগে। ফলে অগত্যা সিদ্ধান্ত হলো, তিনি তিন সপ্তাহের জন্য টোকিওর বাইরে যাচ্ছেন। ফিরবার পূর্ব পর্যন্ত ততদিনে আমাকে এই বাসার চাবিঅলা হয়ে থাকতে হবে।
অভিজাত মহল্লা হলেও বাড়িটা ছিমছাম একথা বলা যাবে না। আগেই বললাম যে অসংখ্য গ্রন্থ ও নানাপ্রকার সাংগীতিক অনুষঙ্গের স্তুপও বলা যায়। এসব সাজিয়ে রাখার লোকও নেই। মাসের পর মাস তালাবদ্ধ থাকে । আর তিনি চাকরি করেন নিগাতা নামে অন্য এক প্রদেশের জয়েৎসু ইউনিভার্সিটি অ্ব এডুকেশন-এ। ছুটিছাটা ও কাজের প্রয়োজনে টোকিও এলে তখন নিজের বাড়িতে থাকেন। অধিকাংশ জাপানিজ বই, সামান্য কিছু ইংরেজি বই, তারও খুব সামান্যই পড়তে পেরেছিলাম। কারণ আমার প্রতি একটি কঠোর নির্দেশনা ছিল, যে তিনি তিন সপ্তাহ পরে যখন আসবেন, তখন একটি কথাও ইংরেজিতে শুনতে চাইবেন না। তবে শৈথিল্যও ছিল কিছুটা, যেমন শব্দ বলেও বাক্যের কাজ সারা যাবে। আমার ঐ বিশ দিন ছিল কঠোর তপস্যার, প্রায় ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা জাপানিজ ভাষা চর্চায় রাখতে হয়েছিল।