শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, শ্রাবণ ১১ ১৪৩১

গারো এলাকায় আমার একদিন

পি আর প্ল্যাসিড, জাপান

প্রকাশিত: ১১:২২, ২৮ নভেম্বর ২০২২

আপডেট: ১০:৫২, ২৯ নভেম্বর ২০২২

গারো এলাকায় আমার একদিন

পি আর প্ল্যাসিড, জাপান প্রবাসী লেখক - সাংবাদিক

আমি আমার ছোটবেলার কথা বলছি। আমার বয়স তখন কতো হবে ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, সেই ছোট সময় থেকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গারো সম্প্রদায়ের কিছু লোককে কাজ করতে দেখেছি। সেই থেকে বাংলাদেশে আদিবাসী এই গারো সম্প্রদায় সম্পর্কে জানা।

নানা কারণে গারোদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠার পিছনে আমার এক জ্যাঠামনির ভূমিকা ছিল, যা না বললেই নয়। জ্যাঠামনির নাম, ফাদার এলিয়াছ রিবেরু (প্রয়াত)। আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে আমি জেনে আসছি জ্যাঠামনি গারো এলাকায় থাকেন। গারোদের নিয়ে কাজ করেন। পরে জেনেছি তিনি যেই মিশনে থাকেন সেই মিশনের নাম ভালুকাপাড়া।

১৯৭৪ এর শেষ কিংবা ১৯৭৫ সালের শুরুর কথা। ভালুকাপাড়া মিশনে জ্যাঠামনির জুবিলি উদযাপন করা হবে। সেই উপলক্ষে আমি স্কুল ছুটি করে ভালুকাপাড়া গিয়ে অনেকদিন ছিলাম। তার আগে একবার গিয়েছিলাম বড়ভাই-বৌদি আর মা সহ। সেইবার অল্প কয়দিন ছিলাম গারো এলাকা, ভালুকাপাড়া মিশনে জ্যাঠামনির কাছে। সেই সময়কার কথা আমি বিন্দু মাত্র ভুলে যাইনি। সে-বার আমরা আসতে যেতে প্রয়াত প্রমোদ মানখিনের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেছি।

এরপর আমার বোঝার ক্ষমতা হলে অর্থাৎ স্কুল জীবন থেকে একসাথে পড়ালেখা করতে গিয়ে জীবনে অনেক গারো সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রায় সবার কথাই আমার মনে আছে। জাপান আসার পর এখানকার আদিবাসী সমাজ আইনুদের কিছু লোকের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে ভাবছিলাম তাদের (সংগঠনের) সাথে আমাদের দেশের গারো সম্প্রদায়ের লোকদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না। সেই সুবাদে ভালো বিশ্বস্ত কাউকে দীর্ঘসময় ধরে খুঁজছিলাম। এর মধ্যে একজনকে পেয়ে তার মাধ্যমে কাজের যাত্রা শুরুও করেছিলাম। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, নানা কারণে কাজটি বেশিদূর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় নি। যে কারণে বাধ্য হয়ে সেই চিন্তা থেকে সরে আসতে হলো আমাকে।

সম্প্রতি ফেসবুকের বদৌলতে গারো সম্প্রদায়ের অনেকের সাথে আমার যোগাযোগ এবং সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের কারো কারো সাথে কথা বলার সময় আমি ভালুকাপাড়ায় আমার পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে কথা বলি। তারাও আমার কথার সূত্র ধরে কথা বলে দেশে গেলে যেন অবশ্যই ভালুকাপাড়া বেড়াতে যাই, আবদার করেন। ভালুকাপাড়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে আমিও ভালুকাপাড়া যাবার কথা স্থির করি।

এবছর (২০২২) বিশেষ কাজে দেশে গিয়েছিলাম। আমার কাজটি ছিল ভারতের আগরতলায়, তাই আগরতলা গিয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য। দেশে ফিরে এসে ময়মনসিংহ শহরে মনেস্টারি সম্প্রদায়ের সিস্টারদের বাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে কথায় কথায় সিস্টার মাগ্রেট মেরীকে বললাম আমি ভালুকাপাড়া মিশনে যেতে চাই। একা তো আর চিনে যেতে পারবো না, যদি সাথে যান কিংবা সাথে নিয়া যাবার জন্য কাউকে ঠিক করে দেন তাহলে ভালো হয়। আমার কথা শুনে সাথে সাথে সিস্টার মাগ্রেট মেরী রাজী হয়ে মাদারকে জানালেন। মাদার আমার সাথে যাবার জন্য সিস্টার মাগ্রেট মেরীকে অনুমোদনও নিলেন। আমি তো সিস্টারের আগ্রহ দেখে তখন মহা খুশী।

সিস্টার মাগ্রেট মেরীও একজন গারো। যে কারণে গারো এলাকা ভালুকাপাড়ায় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে আমার সুবিধা হবে ভেবে তাকে নিয়ে পরেরদিন খুব ভোর বেলা ময়মনসিংহ শহর থেকে রওনা দিলাম। রাস্তায় যেতে যেতে শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। বৃষ্টির মাঝে অটোতে বসে একদম ভিজে-ই আমরা যেতে থাকি। এক সময় অটো থেকে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। পাহাড় দেখতে পেয়ে মনে একপ্রকার প্রশান্তি এলো। বৃষ্টি থামলে এরই মধ্যে গিয়ে পৌঁছলাম ভালুকাপাড়া মিশনের সামনে।

যেতে যেতে পথে পুরোনো অনেক স্মৃতি রোমন্থন করলাম। পুরোনো সেই নদী, রাস্তা-ঘাট, বাজার কতো কিছু। প্রথম যাত্রাকালের কথা, তখন আমরা কখনো গরুর গাড়িতে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো মায়ের কুলে চড়ে গিয়েছিলাম ভালুকাপাড়া মিশনে এবারভালুকাপাড়া আসতেই আমার চোখে যা ধরা পড়লো তাতে আগের অনেক কিছু বদলে গেছে। রাস্তা পাকা হয়েছে। সেই রাস্তায় চলছে বাস ট্রাক, অটো, রিকশা আরো কতো ধরনের যান।একসময় যখন ভালুকাপাড়া গির্জার সীমানায় ঢুকলাম তখন আনন্দে আমার ভিতর নেচে উঠলো। একটু সময় গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখছিলাম আর দৃশ্য ও স্থাপনার মিল খুঁজছিলাম।

সিস্টার মাগ্রেট মেরী জানতে চাইলেন, কি দাদা, পুরানো স্মৃতি মনে পড়ছে? তাঁর প্রশ্ন শুনে আমি হাসলাম। আনন্দে আর উত্তর দিতে পারছিলাম না। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির মৌ মৌ গন্ধ নাকে আসছিলো। তাকিয়ে দেখছি, আগে যেখানে মাঠ ছিলো সেখানে এখন আকাশ পানে তাকিয়ে থাকা নানা জাতের বৃক্ষ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

জুতার মধ্যে লেগে থাকা লাল মাটি ভেজা সবুজ ঘাসের মধ্যে ঘষতে ঘষতে গিয়ে পৌঁছলাম ফাদারের ঘরের সামনে। সামনেই ঘরের বারান্দায় তখন ফাদার এক খ্রিষ্ট ভক্তকে নিয়ে বসে কথা বলছিলেন। নমষ্কার দিয়ে পরিচিত হলাম ফাদারের সাথে কথা বলে।ওনার নাম অন্জন জাম্বিল।

ফাদার আমাদের আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করলেন। ফাদারকে তখন স্থানীয় দু'জন লোক সম্পর্কে বলে বললাম, তাদের সাথে আমি দেখা করতে আগ্রহী। তাদের একজন হলেন স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা অপরজন ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। দু'জনের কারো নামই সঠিক বলতে পারিনি। তবে আমার দেয়া বিবরণ সঠিক থাকায় মিস্ত্রির নাম সঠিক বলে দিলেন। আর ঠিক সেই সময় তার স্ত্রী সেখানে একটি দরকারে এসে হাজির হলেন। স্ত্রীর নাম মালা।
 
আমার কি সৌভাগ্য, মন থেকে যার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছি অল্প সময়ের মধ্যেই তার সন্ধান আমি পেয়ে গেলাম। পরে বিকেলে তার বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে চা খেয়ে এসেছি। নাম তার ক্ষেত্র মিস্ত্রি। তিনি অবশ্য এখন আর বেঁচে নেই। তার কবর দেখে তার আত্মার শান্তি চেয়ে প্রার্থনা করে এলাম।

কিন্তু অন্য আরেকজন যেই শিক্ষিকার কথা বললাম তাকে আর শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। আমার কাছে শিক্ষিকার নামটি মেরী মনে হয়েছিলো। এই নামে কেউ তার হদিস দিতে পারেন নি। এটা ১৯৭৪/৭৫ এর কথা। সেই সময় তিনি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

ফাদারের সাথে কথা বলে সেখান থেকে পাশেই সিস্টারদের বাড়ি গেলাম। আগে থেকেই সিস্টার মাগ্রেট মেরী আমাদের যাবার কথা বলে রেখেছিলেন। তাই আমাদের দুপুরে খাবার আয়োজনও করে রেখেছিলেন তারা। তাদের খুব সুস্বাদু খাবার আয়োজনের কথা সত্যিসত্যিই ভোলার নয়।

সিস্টারদের বাড়ি যাবার আগে স্কুল পরিদর্শন করলাম। এরপর তাদের পরিচালিত ক্লিনিক ঘুরে দেখালেন। সেখানে সিস্টারদের একজন আমাদের এলাকার সিস্টার। সম্পর্কে আমার আত্মীয়, নাম হ্যাপি গমেজ। সিস্টারদেরকে আমার লেখা বই উপহার দিয়ে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একসাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম।

ফিরে আসার সময় কাছেই মিশনের সীমানা ঘেঁষে এক নদী, নাম নিতাই নদী। নদীর পাড় ঘেঁষে অনেকটা সময় কাটিয়ে গ্রাম ঘুরতে গেলাম। যেই নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটলাম ছোটবেলা এই মিশনে থাকাকালে এই নদীর পানিতে গোসল করেছি, সাঁতার কেটে এপাড় ওপাড় গিয়েছি। সময় অসময় নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে জোয়ারভাটা দেখেছি। ওসব স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম আর সিস্টার মাগ্রেট মেরী আর সিস্টার হ্যাপী গমেজের সাথে গল্প করছি।

সেখানেই গ্রামে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে ভূমিহীনদের দেয়া কিছু বাড়ি ঘুরে দেখলাম। গ্রাম ঘুরে দেখে যখন ফিরে আসি তখন মন বলছিলো আর ক'টা দিন আমি এই অজপাড়া গাঁয় থেকে যাই। পাহাড়ি গারো এলাকার মানুষদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে এই অল্প সময় কিছু না। তাই আবার সময় সুযোগ করে যাবার ইচ্ছে নিয়ে ফিরে আসতে হলো। সিস্টার মাগ্রেট মেরীকে আসতে আসতে বললাম আবার যখন এই গারো এলাকায় আসবো তখন এই এলাকা নিয়ে নতুন একটি উপন্যাস লিখবো, নাম হবে "পাহাড়ি মেয়ে"।

ইচ্ছে ছিলো সেদিন ফাদার গৌড় জে পাঠাং এর বাড়ি গিয়ে ঘুরে দেখে আসার। কিন্তু আবহাওয়া ঠিক অনূকূলে না থাকায় ইচ্ছে আর পূরণ করে আসতে পারিনি। চলে এলাম আবার ময়মনসিংহ শহরে আমাদের গন্তব্যে। আসতে আসতে অনক রাত।