শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, আশ্বিন ২০ ১৪৩১

জাপানের পথে পথে (পর্ব-৬) শিক্ষানীতি ও বাদ্য নির্বাচন

সাইম রানা

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ১৩ এপ্রিল ২০২২

জাপানের পথে পথে (পর্ব-৬) শিক্ষানীতি ও বাদ্য নির্বাচন

জাপানের পথে পথে (পর্ব-৬)

জাপানিজ ভাষায় শিক্ষককে সেনসেই বলে, আর শিক্ষার্থীকে বলে গাকুসেই। (যদিও গাকুসেই বলতে শিক্ষা সংক্রান্ত অধ্যাদেশকেও বোঝানো হয়) তবে ছাত্ররা শিক্ষককে সেনসেই বলে সম্বোধন করলেও শিক্ষকরা গাকুসেই বলে সম্বোধন না করে নামের সাথে ‘সান’ যুক্ত করে নেয় । যেমন আমি কিয়োকোকে সেনসেই বলা শুরু করলাম আগের দিন আইওইন টেম্পল থেকে ফেরার সময় থেকে, আর তিনি আমাকে ডাকলেন রানা সান, যদিও ‘র’ ধ্বনিটি অনেকটা ‘ল’ এর মতো হয়ে যায়, আবার ‘ল’ ও ‘র ‘ এর কাছাকাছি, যেমন ইংলিশকে শুনতে ইংরিশ মনে হয়। ছোট ছোট করে জাপানিজ শব্দ বুঝতে শুরু করেছি।


আজও ভোরে ঘুম ভেঙেছে। ভাবলাম একটু ভোরের হাওয়া লাগিয়ে আসি। রাস্তায় দু’ একজন মানুষ জগিং করছে, বাড়িটার পেছন দিকে পাহাড় তবে পুরনো জনবহুল মহল্লা বলে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট কাঠের ঘর একে উপরের ঘাড়ের উপর উবু হয়ে বসে আছে মনে হচ্ছে। সূর্যের তির্যক আলো শহরে এসে না পৌঁছুলেও পাহাড়ের চূড়ায় রঙিন ঘরগুলোকে দ্যুতিময় করে তুলেছে। সুনসান নীরবতা। শহরের ভেতরের সরুপথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে রেল লাইন পার হওয়ার কালে শুনতে পেলাম টিনটিন করে বাজতে থাকা অবিরত ঘণ্টাধ্বনি। পাশে একটি নতুন বাড়ি উঠছে। কাঠের বাড়ি। চারিদিকে মশারির জাল দিয়ে ঢাকা। উলটোদিকে গভীর ঘন বন, বনের ভিতর পুরনো মন্দির। ভেতরে ঢুকবার ইচ্ছে হল, কিন্তু ফিরতে দেরি হয়ে যাবে ভেবে অন্যদিন আসবো মনঃস্থির করে ফিরে এলাম। রাস্তার নাম, সাইনবোর্ড, লোকেশন সবই জাপানিজ ভাষায় লেখা, ফলে কোনোকিছুই বুঝতে পারছি না। ঘরে ঢুকে দেখি কিয়োকো সেনসেই উঠে পড়েছেন। আমি কিচেনটা একটু পরিষ্কার করলাম, ফ্রিজ থেকে কিছু ফলমূল, ব্রেড ভোরেই বের করে রেখেছি। তিনি নাস্তার আয়োজন করছেন। চোখাচোখি হতেই সম্বোধন করলেন ‘ওহাইয়ও গজাইমাসু’ , আমি উত্তর দিলাম একই বাক্যে যার অর্থ ‘শুভ সকাল’ । এরপর তিনি ডিম ও কিছু সবজি দিয়ে ছোট বার্গার বানালেন, নিগাতা থেকে নিয়ে আসা নিজের বাসায় আবাদ করা খয়েরি আঙুর, ব্লুবেরি জ্যাম ইত্যাদি।


নাস্তা খেতে খেতে বললেন, ‘তুমি জাপানিজ সংগীত সম্পর্কে জানার তো প্রায় এক বছর সময় পেয়েছ, কী জেনেছ বা এখানে তোমার কী বিষয়ে আগ্রহ সে সম্পর্কে একটু ধারনা দাও’ । আমি বললাম উইলিয়াম পি মাল্ম এর ট্র্যাডিশনাল জাপানিজ মিউজিক এন্ড মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টস বইটির কিয়দংশ পড়েছি। জানতে চাইলেন কোথা থেকে সংগ্রহ করলাম। উত্তর দিলাম বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাস থেকে সংগ্রহ করেছিলাম বলার পর তিনি খুব খুশি হলেন, এবং বললেন ‘এই বইটি হলো জাপানিজ মিউজিকের বাইবেল, এটা পড়ে ভালোই করেছ।’ মজার ব্যাপার হল জাপানিজ সংগীতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একজন ইউরোপিয়ান লেখকের গ্রন্থকেই তিনি সরবচ্চ মূল্যায়ন করলেন। এরপর কথা হলো ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস সম্পর্কে। বাংলাদেশের সংগীতের নানাদিক আমি যতটুকু সম্ভব কথা শেষ করতেই তিনি বললেন আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমার কাছ থেকে ভারতীয় সংগীতের জ্ঞান পাবো, এখন দেখছি তুমি বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারনা যাই রাখো তা আধুনিক যুগের ইতিহাস, ভারতীয় সংগীত সম্পর্কে তোমার থেকেও আমি ভাল ধারনা রাখি মনে হচ্ছে। একথা শুনে আমি একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেলাম।


জাপানিজদের সব থেকে বড়ো গুণ যে কোনও কিছু শেখার উৎসাহ বোধ করা। এবং তারা মনে করে প্রত্যেকের শেখার সামর্থ্য সমান, হয়তো কাউকে একটু বেশী বা কম সময় দিতে হয়। জনগণ ও শিক্ষকদেএ এই ধারনার একারণেই তাঁরা এতো অগ্রগামী। এবং তারা যে কোনও তথ্য ও জ্ঞানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা পূর্বক তা গ্রহণ, বর্জন এবং সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়। এক বছর আগে আমার একটি আবেদনপত্রকে তিনি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে তা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাস্তবায়ন করেছেন, কারণ এই উদ্যোগ গ্রহণের পেছনে তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ নিতান্তই সামান্য ছিল। মূলত দেশ ও দেশজ সংস্কৃতিকে বিশ্ব জনপদের কাছে তুলে ধরার সুযোগকেই বড়ো করে দেখেছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের শিক্ষানীতির একটি দিক উত্থাপন না করলেই নয়, ১৮৬৮ সালে মেইজি যুগের শিক্ষানীতিকে জাপানিজরা আধুনিক জাপানের গুরুত্বপূর্ণ দলিল বিবেচনা করে। সেখানে বলা হয়েছিলো যে দেশকে শক্তিশালী করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞান সংগ্রহে উদ্যোগী হতে হবে।সেই পথে তারা অনেক দূর এগিয়েছে, এখন তারা নিজেদের সেই উচ্চতাকে বিশ্বজনপদের কাছে পৌঁছে দিতে চায়।মেইজি যুগের আগে তারা তোকুগাওয়া যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমাত্র নিজ উন্নতির পথে হেঁটেছিল। তাঁদের তিন ধরনের পদক্ষেপই বৈশ্বিক শিক্ষামূল্যায়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।
আমরা আসার আগে গত এক বছর ধরে তিনি ভারতীয় সংগীতের ইতিহাস পড়েছেন, যে পঠনের কাছে আমি নিতান্তই শিশু হয়ে গেলাম, কারণ প্রাচীন ভারতীয় সংগীতের রূপরেখা, ধ্রুপদ, বেদ, মতঙ্গ, যাজ্ঞ্যবল্ক, এমনকি কর্ণাটকী সংগীত, বীণা, সেতার, তবলা-পাখোয়াজ এসব নিয়ে আমার ধারনা ততটা গভীরে ছিল না। স্বল্প প্রাকৃতিক সম্পদের দেশে প্রায় আশিভাগ শিক্ষা ও জ্ঞান পুঁজি নিয়েই তাঁরা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করেছে।


আমার প্রস্তাবিত স্কলারশিপের শিরোনাম ছিল ‘ট্র্যাডিশনাল মিউজিক অফ জাপান’, সে সূত্রে জানতে চাইলেন আমি যেকোনো একটি বাদ্য শেখার জন্য নির্বাচন করতে পারি, অথবা একগুচ্ছ। আমি জানতে চাইলাম তাঁর অভিমত কী, কোনটা আমার জন্য বেশি ভালো হবে? তখন তিনি বললেন, ‘যদি তুমি কম্পোজিশনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাবো, তাহলে ৫/৬ টি বাদ্য শিখতে পারো, এতে প্রতিটি বাদ্যের চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারবে। মিউজিকোলজির ভাবনা থেকে এটা চমৎকার। আর একটি বাদ্য শিখলে দশমাসের তুমি ভালভাবেই রপ্ত করতে পারো একজন বাদনশিল্পী হিসেবে। সেক্ষেত্রে তুমিই নির্ধারণ করতে পারো কোনটি তোমাকে বেশি আকর্ষণ করে বা কোন যন্ত্রের সাথে তোমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।’ আমি বললাম, ‘কম্পোজিশন এবং মিউজিকলজির প্রতি মনোযোগ বেশি।’
তিনি বললেন, ‘সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমি একজন পিয়ানোবাদক, টোকিও ওঙগাকু বিজুতসু দাইগাকু থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছি। অতঃপর মিউজিকোলজি নিয়ে কাজ করছি। তুমি প্রধানত সামিসেন (দোতারা সদৃশ তিন তারের বাদ্য, কোটো (বারো তারের বাদ্য), কোকিউ (তিন তারের বেহালা), কোৎসুজুমি (ছোট ড্রাম বা পোহল বিশেষ), এবং বাসায় পিয়ানো শিখতে পারো। প্রতিটির জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান তোমার জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। সব ধরনের শিডিউল ও সমন্বয় করে দেবে সাইতো সান। তো এখন আমরা মার্কেটের দিকে বের হতে পারি, তোমার কিছু জরুরী কেনাকাটা করা যেতে পারে, বিশেষ করে শিক্ষা ও গবেষণা সামগ্রী সংগ্রহের জন্য।